টমেটো
টমেটো এমন একটি সবজি যা প্রত্যেকের রান্নাঘরে উপস্থিত থাকে। যেকোনো রান্নায় টমেটো ব্যবহার রান্নায় আলাদা স্বাদ এনে দেয়। প্রচুর পরিমাণে এন্টি অক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ এই টমেটো ক্যান্সার, ডায়াবেটিস বা হার্টের যেকোনো রোগ থেকে উদ্ধার করতে পারে।
টমেটোর বৈজ্ঞানিক নাম হল সোলানাম লাইকোপারসিকাম যা সবার প্রথম মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় পাওয়া যায়। তবে এখন এই টমেটো সারা পৃথিবীতেই চাষ করা হয়, তবে এক একটি দেশের আবহাওয়ায় টমেটোর প্রকৃতিও এক এক রকম হয়ে থাকে।
যারা ওজন বৃদ্ধির সমস্যায় ভোগে ও ওজন হ্রাস করার প্রচেষ্টায় আছে বা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তাদের জন্যে টমেটো দারুণ উপকারী। এছাড়া ডায়াবেটিসের জন্যেও টমেটো খুব উপকারী। একথা অনেক আগেই প্রমাণিত হয়েছে যে, গর্ভবতী মহিলাদের জন্যে এই টমেটো বিশেষ উপকারিতা প্রদান করে থাকে। টমেটোতে থাকা লাইকোপেন শরীরের নানা সমস্যা রোধ করতে বিশেষ সহযোগিতা করে কারণ এর থেকেই তৈরী হয় এন্টি অক্সিডেন্ট।
টমেটোর নানা ধরণ রয়েছে যেমন প্লাম টমেটো, চেরি টমেটো, গ্রেপ টমেটো, বিফস্টিক টমেটো এবং টমবেরি। সারা পৃথিবীতে নানা রকমের টমেটো চাষ করা হয় কিন্তু সব থেকে প্রচলিত ধরণের টমেটো হল লাল রঙের টমেটো। টমেটো গাছ সাধরণত ৪ থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা হয় ও এর পাতা একটু লোমশ ধরণের হয়ে থাকে। লাল টমেটো ছাড়া হলুদ, কমলা, কালো,বাদামি, সাদা, গোলাপি ও বেগুনি রঙের টমেটোও চাষ করা হয়ে থাকে। আমাদের আজকের পোস্টে আমরা টমেটো সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে কিছু তথ্য প্রদান করতে চাই যা আপনার জানা খুবই প্রয়োজন। আসুন সবার আগে দেখে নেওয়া যাক টমেটোর উপকারিতা।
শরীরের যে কোনো সমস্যা প্রতিরোধ করতে টোমেটো বিশেষ ভাবে সাহায্য করে থাকে। স্বাস্থ থেকে শুরু করে ত্বক ও চুল সব কিছুর ক্ষেত্রেই টমেটো দারুন উপকারী। সবার আগে দেখে নেওয়া যাক স্বাস্থ্যের ওপর টমেটোর উপকারিতা।
স্বাস্থ্যের জন্য টমেটোর উপকারিতা
হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য : Bone and Teeth Health
একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রতিদিন মাত্র দু গ্লাস টমেটোর জ্যুস পান করলে হাড় ও দাঁতকে মজবুত রাখা যায়। এর ফলে অস্টিওপরোসিস, ক্যাভিটি, ইত্যাদি রোধ করা যায়। টমেটোয় রয়েছে উচ্চ বিটা
ক্যারোটিন যা শরীরে প্রবেশ করলে ভিটামিন এ-তে পরিণত হয় যার ফলে হাড়ের শক্তি ও কাঠামো বজায় থাকে (১)। ভিটামিন সি হাড় গঠন করতে ও শরীরের কিছু প্রয়োজনীয় কোষ তৈরী করতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি এর অভাব হলে হাড় ও দাঁত ধীরে ধীরে খসে যেতে শুরু করে। এক্ষেত্রে টমেটো ওষধির ভূমিকা নিয়ে থাকে (২)। টমেটোয় থাকা লিউটিন কোলাজেন তৈরী করতে সাহায্য করে। এছাড়া টমেটোয় রয়েছে ভিটামিন কে যা ভিটামিন ডি এর সাথে মিশে হাড় ও দাঁতের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
দৃষ্টি শক্তি বাড়ায় ও চোখের সমস্যা রোধ করে: Vision Health and Eye Diseases
ভিটামিন এ দ্বারা সমৃদ্ধ টমেটো চোখের জন্যে দারুণ উপকারী। বিশেষত চোখের মণি ভালো থাকার একটি প্রধান কারণ হল ভিটামিন এ যার ঘাটতি হলে অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। টমেটোয় থাকা লাইকোপেন সেই সমস্ত রেডিক্যাল দূর করে যা চোখের নানা রোগের কারণ হতে পারে। এমনকি, সূর্যের প্রখর তাপ থেকে চোখকে রক্ষা করে এই লাইকোপেন। টমেটোতে থাকা ভিটামিন সি ও কপার বয়স বাড়ার ফলে ছানি বা বিভিন্ন সমস্যাকে অনায়াসে রোধ করতে পারে। চোখের স্বাস্থ্যের জন্যে লিউটিন যা আসলে একটি ক্যারোটিনয়েড ফাইটোকেমিক্যাল, খুবই প্রয়োজনীয় (৩), তা টমেটোতে পাওয়া যায়, এর ফলে দৃষ্টি শক্তি সজীব থাকে।
ওজন হ্রাস করে: Weight Loss
টমেটোর দ্বারা খুব সহজে ওজন ও শরীরের বাড়তি মেদ কমানো যায় (৪)। এছাড়া টমেটো কোলেস্টরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে যা ওজন বৃদ্ধির মূল কারণ। এন্টি অক্সিডেন্ট ছাড়া টমেটোতে রয়েছে ফাইবার ও খুবই কম ক্যালোরি। স্প্রিরি কম ক্যালোরি প্রবেশ করলে ওজন অনায়াসে নেমে যায়।
ডায়াবেটিস: Diabetes
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষদের জন্যে টমেটো একটি অতি প্রয়োজনীয় খাদ্য। এর মূল কারণ টমেটোতে রয়েছে উচ্চ ভিটামিন সি ও ই যা ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলিকে প্রতিরোধ করে (৫)। এছাড়া টমেটোর ইনডেক্স খুব কম হওয়ার ফলে রক্তে সুগারের মাত্রা কমে। শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিন টমেটো খাওয়ার ফলে ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতাও একেবারে কমে যায় (৬)। প্রতিদিন ২০০ গ্রাম টমেটো খেলে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ফলে যে উচ্চ রক্তচাপ হয়, সেটাও কমে আসে (৭)। এছাড়া টমেটোতে থাকা লাইকোপেন ডায়াবেটিসের অক্সিডেটিভ চাপ কমিয়ে আনে (৮)।
ক্যান্সার: Cancer
টমেটোতে থাকা লাইকোপেনে রয়েছে এন্টি ক্যান্সার উপাদান (৯)। লাইকোপেন হল এন্টি অক্সিডেন্ট যুক্ত এক ধরণের ক্যারোটিনয়েড যা শরীরে নানা রকমের ক্যান্সার উৎপন্ন করা জীবাণু শেষ করে ফেলে। এমনকি টমেটো দিয়ে তৈরী সস, জ্যুস বা অন্য কোনো পেস্টও ক্যান্সার রোধ করতে বেশ কার্যকরী কারণ এগুলিতে থাকে অতিরিক্ত পরিমাণ লাইকোপেন (১০), (১১)। একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে টমেটোর দ্বারা প্রোস্ট্রেট ক্যান্সার রোধ করা যায় (১২)। টমেটোর এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান ব্রেস্ট ক্যানসারও রোধ করে (১৩)। ক্যান্সারের কোষ বৃদ্ধি থেকেও প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে টমেটো (১৪)।
উচ্চ রক্তচাপ কমায়: Blood Pressure
টমেটোতে থাকা লাইকোপেন উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে (১৫)। এছাড়া টমেটোয় রয়েছে পটাসিয়াম যা রক্তচাপ কমানোর ক্ষেত্রে ওষুধের মত কাজ করে কারণ পটাসিয়ামের সাহায্যে সোডিয়ামের মাত্রা কম করা যায় (১৬)। বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষকে রোজ ৪৭০০ মিলিগ্রাম পটাসিয়াম গ্রহণ করা উচিত। তবে অতিরিক্ত পটাসিয়াম গ্রহণ করলে কিডনির সমস্যাও দেখা যেতে পারে। টমেটো দ্বারা খুব কম সময়ে উচ্চ রক্তচাপ অনেকটা কমে আসে (১৭), (১৮)। টমেটোয় রয়েছে ভিটামিন সি যা আরেকটি কারণ উচ্চ রক্ত চাপ কমিয়ে আনার জন্যে (১৯)।
এন্টি ইনফ্লেমেটরি: Anti-Inflammatory
টমেটোয় রয়েছে নানা রকমের এন্টি অক্সিডেন্ট যেমন জিটা ক্যারোটিন, ফাইটোফ্লুএন্স ও ফাইটোন। এগুলি শরীরের ফোলাভাব কমিয়ে ক্যান্সার ও আর্থ্রাইটিস রোধ করতে সাহায্য করে। টমেটোতে থাকা লাইকোপেনও ইনফ্লেমেশন কমাতে সাহায্য করে (২০), (২১)। এই কারণে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় টমেটো অবশ্যই যোগ করা উচিত (২২)। চেরি টমেটো রোস্ট করেও আপনি খেতে পারেন। এটি খেতে ও দেখতে দুই দিক থেকেই দারুণ। লাইকোপেন ছাড়া, ভিটামিন সি-ও ইনফ্লেমেশন রোধ করতে সাহায্য করে (২৩)।
গর্ভাবস্থার জন্যে ভাল: Good in Pregnancy
গর্ভাবস্থার সময় ভিটামিন সি প্রত্যেকটি মহিলার জন্য প্রয়োজন। এর ফলে গর্ভের শিশুর হাড়, দাঁত ও মাড়ি মজবুত হয়। টমেটোতে থাকা ভিটামিন সি শরীরে আয়রন শোষণ করতে সাহায্য করে (২৪)। তাই এই সময় আয়রন ট্যাবলেট ছাড়া টমেটো খাওয়াও খুব জরুরি। এছাড়া টমেটোর লাইকোপেন গর্ভবতী মহিলার শরীরে এন্টি অক্সিডেন্ট উৎপাদন করে। এমনকি, ডায়াবেটিস রোধ করতেও সাহায্য করে (২৫)।
পুরোনো ব্যাথা কমাতে: For Old Pains
টমেটোতে থাকা লাইকোপেন ও ভিটামিন সি শরীরের যেকোনো ব্যাথা বা পীড়া কমাতে সক্ষম। আগেই বলা হয়েছে যে, টমেটোতে রয়েছে এন্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান। এর ফলে শরীরে থাকা দীর্ঘদিনের ব্যাথা বা জ্বালা খুব সহজেই টমেটোর গুণাগুণ দিয়ে সারিয়ে তোলা যায়।
হার্ট রেট ও কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণ করে: Controls Heart Rate and Cholesterol
শুধুমাত্র লাইকোপেনের গুণে শরীরের বাজে ও অপ্রয়োজনীয় কোলেস্টরল প্রায় ১০% রোধ করা যায়। কোলেষ্ট্ট্রোল নিয়ন্ত্রণ করতে প্রয়োজন প্রতিদিন প্রায় ২৫ গ্রাম লাইকোপেন গ্রহণ করে। প্রতিদিন ২০০ গ্রাম টমেটোর রস এই লাইকোপেন প্রদান করতে সক্ষম ও ভালো কোলেস্টরল উৎপন্ন করে (২৬), (২৭)। যেইসব মহিলাদের অতিরিক্ত ওজন বেড়ে যাওয়ার ফলে কোলেস্টরল বেড়ে যায়, তাদের ক্ষেত্রে টমেটো খুব কার্যকরী (২৮)। টমেটোতে রয়েছে উচ্চ পরিমাণ বিটা ক্যারোটিন, ফোলেট ও ফ্ল্যাভোনয়েড যা হার্টের স্বাস্থ্যের জন্যে খুব প্রয়োজনীয়। এর ফলে হোমোসিস্টিন ও ফ্লেটেটেট নামক ক্ষতিকারক পদার্থগুলি যা হার্টের ক্ষতি করতে পারে, তা নষ্ট হয়ে যায় (২৯)। লাইকোপেন যেহেতু ফ্যাটের সাথে গুলে যায়, তাই এটি হার্টকে রক্ষা করে সহজেই অপ্রয়োজনীয় ফ্যাটকে প্রতিরোধ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়: Boost Immunity
প্রতিদিন টমেটো খাওয়ার ফলে সাদা রক্তকণিকা সঠিক ভাবে তার কার্যকারিতা পালন করে। এর ফলে শরীরে যেকোনো রোগ প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া ক্যারোটিনয়েড যুক্ত টমেটো রোগ প্রতিরোধ করতে দারুণ সক্ষম (৩০)।
রক্ত জমাট বাধা আটকায়: Prevent Blood Clots
টমেটোতে থাকা লাইকোপেন উচ্চ রক্তচাপ কমিয়ে অনায়াসে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি করে ও রক্তকে জমাট বেঁধে যাওয়া থেকে রক্ষা করে। এর ফলে হেমোরেজ অর্থাৎ রক্ত ক্লট হয় না ও রক্ত চাপ মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে।
মাংস পেশী গঠন করে: Muscle Building
টমেটো বিশেষ করে সবুজ রঙের টমেটোতে টোমাটিডাইন বলে একটি উপাদান থাকে যা মানুষের শরীরের মাংস পেশিকে সঠিকভাবে গঠন করতে সাহায্য করে। এর ফলে আপনি নিজেকে শক্ত পোক্ত অনুভব করতে পারেন ও দীর্ঘ সময়ে ধরে ব্যায়াম করতে পারেন। বিশেষ করে যারা জিমে গিয়ে শরীর চর্চা করেন, তাদের জন্যে টমেটো খুবই প্রয়োজনীয়।
ত্বকের জন্য টমেটোর উপকারিতা – Skin Benefits of Tomato in Bengali
এবারে দেখে নেওয়া যাক ত্বকের জন্যে টমেটো কিভাবে উপকারিতা প্রদান করে থাকে।
ত্বককে উজ্জ্বল ও মোলায়েম রাখতে: Glowing and Smooth Skin
সৌন্দর্য্য চর্চার ক্ষেত্রে টমেটো বিশেষ একটি উপকরণ। রুক্ষ ত্বককে নতুন করে ভেতর থেকে সারিয়ে তুলে তা উজ্জ্বল ও মোলায়েম করে তুলতে টমেটোর জুড়ি মেলা ভার। এর প্রধান কারণ হল টমেটোর এন্টি অক্সিডেন্ট উপাদান।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
ভালো ফলাফল পেতে এই প্যাকটি তৈরী করে সপ্তাহে ৪ দিন করে লাগান। একটি ছোট পাত্র দুধে টমেটো পেস্ট করে অল্প একটু ব্যাসন মিশিয়ে মুখে ও ত্বকের রুক্ষ অংশে লাগিয়ে ৩০ মিনিট রেখে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। খুব দ্রুত ত্বকের মধ্যে তফাৎ দেখতে পাবেন।
বার্ধক্যের ছাপ দূর করে: Anti-Aging
এন্টি অক্সিডেন্ট ও ফাইটোপ্রোটেক্টিভ উপাদানে ভরপুর এই টমেটো বয়সের ছাপ দূর করে ত্বকের বলিরেখা ও অন্যান্য দাগ ছোপ রোধ করতে দারুণ কার্যকরী। টমেটোতে রয়েছে ভিটামিন সি যা দীর্ঘদিন পর্যন্ত ত্বক টানটান রাখে ও সহজে বয়সের ছাপ পড়তে দেয়না।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
প্রতিদিনের ব্যস্ত জীবনে আপনি যেই পরিমাণ ধুলো ও দূষণের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করেন, তার ফলে খুব তাড়াতাড়ি বার্ধক্যের ছাপ পড়ে যায়। তাই বাড়ি ফিরে এসে অল্প এক টুকরো টমেটো নিয়ে সারা মুখে ভালো করে ঘষে আধ ঘন্টা রেখে জল দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি প্রতিদিন করলে ত্বকের যেইসব কোষগুলি দূষণের ফলে নষ্ট হয়ে যায় সেগুলি নতুন করে তরতাজা হয়ে ওঠে ও ত্বককে ভেতর থেকে সারিয়ে তোলে।
ত্বকে হওয়া গর্ত সারিয়ে তোলে: Treat Open Pores
ব্রণ বা যেকোনো ফুসকুড়ি হলে ত্বকে অনেক সময় দীর্ঘ কালের জন্যে গর্তের মত হয়ে একটি ছাপ ফেলে দেয়। এটি সারাতে প্রয়োজন ভিটামিন সি ও লাইকোপেন যার দুটিই রয়েছে টমেটোর মধ্যে। লাইকোপেন ত্বকের কোষ নষ্ট হয়ে যাওয়া রোধ করে ও ভিটামিন সি সূর্যের প্রখর ক্ষতিকারক তাপ থেকে ত্বককে রক্ষা করে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
এক চামচ মধু ও টমেটোর রস একসাথে মিশিয়ে মুখে লাগিয়ে আধ ঘন্টা রেখে দিন। শুকিয়ে গেলে সেটি জল দিয়ে পরিষ্কার করে নিন। এটি সপ্তাহে ৫ দিন ব্যবহার করলে খুব সহজেই ত্বকের গর্ত মিলিয়ে টানটান হয়ে যাবে।
প্রাকৃতিক সানস্ক্রিন: Natural Sunscreen/Prevent Sunburn
বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে প্রতিদিন টমেটো খেলেই তা ত্বককে সূর্যের প্রখর ও ক্ষতিকারক তাপ থেকে সহজেই রক্ষা করতে পারে (৩১)। এছাড়া টমেটো পেস্ট করে মুখে লাগালে তা একটি প্রাকৃতিক সানস্ক্রিনের কাজ করে যা সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মিকে ত্বকে কোনো রকম ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলা থেকে বাঁচায়।
এস্ট্রিঞ্জেন্ট: Perfect Astringent
টমেটো দারুণ একটি এস্ট্রিঞ্জেন্ট হিসেবে কাজ করে যা ত্বকের জ্বেল্লা ও তরতাজা ভাব ফুটিয়ে তোলে। এর ফলে আপনি সারাদিন নিজেকে উজ্জ্বল ও সুন্দর অনুভব করতে পারবেন। এছাড়া টমেটো আপনার ত্বকের অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব কাটিয়ে ব্রণ হওয়াকেও রোধ করে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
এস্ট্রিঞ্জেন্ট হিসেবে টমেটো ব্যবহার করতে হলে আপনাকে টমেটোর সাথে একটু শসার রস একসাথে মিশিয়ে একটি তুলোর সাহায্যে মুখে লাগাতে হবে। এটি ভালো করে লাগিয়ে জল দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। প্রতিদিন ব্যবহার করলে আপনি দীর্ঘকালের জন্যে ভালো ফল উপভোগ করবেন।
প্রাকৃতিক ব্লিচ: Natural Bleaching Agent
টমেটোতে থাকা লাইকোপেন, এন্টি অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি ত্বকে একটি প্রাকৃতিক ব্লিচের কাজ করে। তাই পার্লারে রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ব্লিচ না করে প্রতিদিন এক টুকরো টমেটো মুখে বসে জল দিয়ে ধুয়ে দেখুন। এতে আপনি কোনো ভাবে রাসায়নিক পদার্থের তুলনায় কম তফাৎ বুঝবেন না এবং এটি ত্বকের জন্যে সুরক্ষিত ও প্রাকৃতিক।
আরো ভালো ফল পেতে হলে দু চামচ মধুর সাথে টমেটোর রস মিশিয়ে সেটি মুখে লাগিয়ে আধ ঘণ্টা রেখে দিন। তারপর একটি তুলো ভিজিয়ে আস্তে আস্তে তুলে নিন। এটি দারুণভাবে ব্লিচের কাজ করে।
ত্বকের মৃত কোষ দূর করে: Remove Dead Skin Cells
আগেই বলা হয়েছে যে টমেটো আপনার ত্বককে ভেতর থেকে সারিয়ে তোলে কারণ এতে রয়েছে ভিটামিন সি ও লাইকোপেন। প্রতিদিন টমেটো খেলে বা যেকোনো ওপরে উল্লেখিত প্যাক ব্যবহার করলে আপনার ত্বকের মৃত কোষ গুলি সহজেই সেরে উঠবে ও ত্বককে নতুন করে ডিজেনারেট করবে। এর ফলে আপনি উজ্জ্বল ও টানটান ত্বকের অধিকারী হবেন।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
একটি বাটিতে দু চামচ চালের গুঁড়ো, হাফ কাপ দুধ ও টমেটোর রস মিশিয়ে একটি প্যাক তৈরী করে সারা মুখে লাগিয়ে রাখুন। এক-আধ ঘণ্টা রাখার পর হাতে একটু জল নিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করে তুলে ফেলুন। তারপর একটি হালকা ক্রিম লাগিয়ে নিন। এতে ত্বক একদম টানটান ও মোলায়েম হয়ে যাবে ও সমস্ত মৃত কোষ উঠে যাবে।
চুলের জন্য টমেটোর উপকারিতা – Hair Benefits of Tomato in Bengali
স্বাস্থ ও ত্বক ছাড়াও টমেটোর উপকারিতা চুলের ক্ষেত্রেও নানারকম ভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক:
চুল পড়া বন্ধ করে: Prevent Hair Loss
টমেটোতে যেই পরিমাণ এন্টি অক্সিডেন্ট ও ভিটামিন সি থাকে তা চুল পড়া খুব সহজেই রোধ করে ও নতুন চুল গজিয়ে তা ঘন ও লম্বা করতে সাহায্য করে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
এক বাটি দইয়ের মধ্যে একটি গোটা টমেটোর রস ও লেবুর রস মিশিয়ে সেটি চুলে লাগান ও দু ঘণ্টা রেখে দিন। তারপর একটি হালকা শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে কন্ডিশনার ব্যবহার করুন। খুব দ্রুত ফল পাবেন। ভালো ফল পেতে এটি সপ্তাহে দুবার করে ব্যবহার করুন।
শুষ্ক চুলের জন্যে ভালো: Good for Dry Hair
টমেটো চুলকে মোলায়েম ও উজ্জ্বল করে রাখতে সাহায্য করে। ফলে শুষ্ক ও রুক্ষ চুলের হাত থাকে আপনি অনায়াসে মুক্তি পাবেন।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
দই, টমেটোর পেস্ট, ডিমের সাদা অংশ ও মধু দিয়ে একটি প্যাক বানিয়ে চুলে ভালো করে লাগান। এক ঘণ্টা পর শেম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। প্রত্যেক সপ্তাহে একবার করে এটি ব্যবহার করলে চুল খুব দ্রুত উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।
স্ক্যাল্পের খুশকি ও চুলকানি দূর করে: Treat Dandruff And Itchy Scalp
টমেটোতে থাকা লাইকোপেন ও ভিটামিন সি দুটোই স্ক্যাল্প অর্থাৎ মাথার ত্বকের জন্যে ওষুধের মত কাজ করে। এর ফলে মাথায় খুশকি বা চুলকানি হলে তা অনায়াসে টমেটোর সাহায্যে রোধ করা যায়।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
একটি টমেটোকে দু টুকরো করে এক একটি টুকরো ভালো করে স্ক্যাল্পে ঘষে ঘষে লাগান। তারপর শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলুন।
চুলের কন্ডিশনার: Conditions Hair
টমেটোকে চুলের একটি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে প্রমাণ করা হয়েছে। এর ফলে চুল নরম, উজ্জ্বল ও মোলায়েম হয়ে ওঠে।
কিভাবে ব্যবহার করবেন?
কন্ডিশনার হিসেবে ব্যবহার করতে এক বাটি দই, টমেটোর পেস্ট, এক চামচ ব্যাসন, ডিমের সাদা অংশ, মধু ও দু টুকরো কলা ভালো করে মেখে চুলে লাগান ও ২ ঘণ্টা পর শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহে একবার করে এটি ব্যবহার করলে দারুণ ফল পাবেন।
টমেটোর পুষ্টিগত মান – Tomato Nutritional Value in Bengali
টুকরো করে কাটা কাঁচা টমেটো ১ কাপ (১৮০ গ্রাম)
পুষ্টি মান %
বায়োটিন ২৪%
মলিবডেনাম ২০%
ভিটামিন কে ৭.৯ µg ১৬%
পটাসিয়াম ২৩৭ mg ১২%
কপার ১২%
ম্যাঙ্গানিজ ০.১৫ মিলিগ্রাম ১১%
ফাইবার ৯%
ভিটামিন এ ৮৩৩ IU ৮%
ভিটামিন b৬ ৮%
ভিটামিন বি ৩ ৭%
ফোলেট ১৫ µg ৭%
ফসফরাস ২৪ মিলিগ্রাম ৬%
ভিড়টামিন বি ১৬%
ভিটামিন ই ০.৫৪ মিলিগ্রাম ৬%
ম্যাগনেসিয়াম ১১ মিলিগ্রাম ৫%
ক্রোমিয়াম ৪%
আয়রন ০.৩ মিলিগ্রাম ৩%
জিঙ্ক ০.১৭ মিলিগ্রাম ৩%
কোলিন ৩%
প্যান্টোথেনিক এসিড ৩%
টমেটোর ব্যবহার – How to Use Tomato in Bengali
টমেটো ব্যবহার করার অর্থাৎ খাওয়ার খুব বিশেষ কিছু নিয়ম নেই। তবে কিছু কিছু রেসিপিতে টমেটো যোগ করলে তা দারুণ সুস্বাদু হয়ে ওঠে। দেখে নিন টমেটো ব্যবহার করার বিশেষ কিছু নিয়ম:
ডিমের অমলেট খেতে যদি ভালোবাসেন তাহলে তাতে টমেটো যোগ করে ভাজুন। তারপর ওপরে একটু মাশরুম আর পালক যোগ করে নিন।
সুপের মধ্যে টমেটো যোগ করলে তা দারুণ সুস্বাদু হয়ে ওঠে। ঘরে টমেটো সুপ্ খুব সহজেই বানিয়ে খেতে পারেন।
টমেটো সস বাজারে পাওয়া যায় বা বাড়িতে আপনি অনায়াসে বানাতে পারেন।
স্যালাডের মধ্যে শশা, পেঁয়াজ, গাঁজর, লেটুস, ইত্যাদির সাথে টমেটো কেটে ছড়িয়ে দিন। এটি স্বাস্থ্যের জন্যে খুবই উপকারী।
পাস্তা বা চাউমিন খাওয়ার সময় অন্য কোনো সস না মিশিয়ে ঘরে বানানো টমেটো সস যোগ করে নিন। টমেটোর ক্যালোরি খুবই কম হওয়ার জন্যে এটি আপনার ওজন বৃদ্ধি হতে দেয় না।
সঠিক টমেটো বাছাই করে সেটা অনেকদিন অবধি সুরক্ষিত রাখার উপায়
টমেটো বাছাই করার ও কেনার কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে। আসুন দেখে নেওয়া যাক:
টমেটো কেনার সময় ভালো করে বেছে সেটির গন্ধ নাকে শুঁকে নিন। তাজা টমেটোর মধ্যে একটি সুন্দর ও তরতাজা সুগন্ধ থাকে যা থেকে বোঝা যায় যে সেটি অনেকদিন টাটকা থাকবে।
যেসব টমেটো আকারে গোল ও একটু ভারী মনে হবে সেটিই কিনুন, কারণ এই ধরণের টমেটো সঠিক ও বেশ পুষ্টিকর। দেখে নেবেন যেন টমেটোর গায়ে কোনো দাগ না থাকে, বা কুঁচকে না থাকে।
শুধু গন্ধ না, টমেটো কেনার সময় হালকা করে টিপে দেখে নিন যেন তা বেশি নরম বা জলজলে না থাকে। তাহলে সেটি খুবই শিগগিরি পচে যেতে পারে।
টমেটো কেনা তো হল, এবার দেখে নিন কিভাবে এই টমেটোগুলি আপনি সঠিক ভাবে সংরক্ষিত রাখবেন।
একটি শুকনো পাত্রে তাজা ও পাকা টমেটোগুলি একসাথে রেখে ঠাণ্ডা ও অন্ধকার একটি জায়গায় রাখুন। তবে রাখার সময় বোটার দিক নিচের দিকে রাখবেন। এতে বহুদিন পর্যন্ত টমেটো তাজা রাখা যায়।
টমেটোর একটি বিশেষ ব্যাপার হল এটি ফ্রিজে রাখার প্রয়োজন হয়না। ফ্রিজে রাখলে টমেটোর আসল সুগন্ধ নষ্ট হয়ে যায়। তবে ফ্রিজে যদি রাখেন, তাহলে তা ব্যবহার করার অন্তত এক ঘণ্টা আগে বের করে রাখবেন।
বাজার থেকে বোতল বন্দি টমেটোর কোনো উপকরণ কিনে যদি ব্যবহার করেন তাহলে তা ৬ মাসের মধ্যে শেষ করে ফেলুন এবং অবশ্যই সেটি ফ্রিজে রাখবেন।
টমেটোর ক্ষতিকর দিক – Side Effects of Tomato in Bengali
যদিও টমেটো একটি অত্যন্ত উপকারী খাদ্য তবুও অতিরিক্ত টমেটো খাওয়ার কিছু ক্ষতিকারক প্রভাব পড়তে পারে। দেখে নিন কোন কোন ক্ষেত্রে টমেটো আপনার জন্যে ক্ষতিকারক হতে পারে:
টমেটোর পাতা বেশ বিষাক্ত। বেশি টমেটোর পাতা খেলে তা শরীরে বিষক্রিয়াকরণ করতে পারে। এছাড়া বেশি টমেটো খেলে পেট খারাপ বা ডায়রিয়া হতে পারে (৩১)। টমেটোর পাতা থেকে গলায় চুলকানি, এলার্জি, মাথাব্যথা, ক্লন্তি, ইত্যাদি বেড়ে যায়। এর ফলে মৃত্যুও হতে পারে।
এসিড
টমেটো প্রাকৃতিক ভাবে এসিডিক যার ফলে অতিরিক্ত টমেটো খেলে অম্বলের সমস্যা হতে পারে। এর ফলে বুকে জ্বালাভাব হতে পারে।
পেট খারাপ
বেশি টমেটো খেলে পেটের নানা রকমের সম্যস্যা হতে পারে যেমন পেট ব্যাট, গ্যাস, ইত্যাদি।
কোষ্ঠকাঠিন্য
টমেটোতে রয়েছে প্রচুর ফ্রুকটোজ যা কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণ হতে পারে। এছাড়া টমেটোতে থাকা সেলিসাইলেট, গ্লুটামেট ও এমাইন কোষ্ঠকাঠিন্যের বড় কারণ হতে পারে।
সোডিয়াম
বোতল বন্দি টমেটো যেমন সস, সালসা বা সুপে থাকে প্রচুর সোডিয়াম যা উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে। যেখানে এক কাপ তাজা টমেটোতে থাকে ৯ মিলিগ্রাম সোডিয়াম সেখানে এই সস বা অন্যান্য উপকরণে থাকে ৫৬৪ মিলিগ্রাম সোডিয়াম। এছাড়া বোতলবন্দি টমেটো উপকরণের থেকে তাজা টমেটো খাওয়াই বেশি ভালো।
তবে যাই হোক না কেন, যেকোনো খাদ্যের মত, অতিরিক্ত টমেটো খেলেও কিছু কিছু ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে ঠিকই, কিন্তু সাবধানে খেলে বা ব্যবহার করলে অপকারের চেয়ে উপকারিতা পাবেন বেশি। টমেটোর মধ্যে থাকা ভরপুর ভিটামিন সি, এন্টি অক্সিডেন্ট ও লাইকোপেন শরীরের জন্যে যে কতখানি প্রয়োজনীয় তা আপনি আগেই পড়েছেন। তাহলে কেনই বা এই টমেটো আপনি আপনার প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যোগ করবেন না? আজ থেকে প্রতিদিন খাওয়া শুরু করুন টমেটো। রান্নায় হোক বা স্যালাড হোক বা এমনি কাঁচা অবস্থায় হোক, আপনি যেভাবে খুশি টমেটো খেতে পারেন। এটি স্বাস্থ্য, চুল ও ত্বক তিনটির জন্যেই খুব উপকারী।